সংস্কৃতির সংগ্রামঃ চিরন্তন দ্বন্দ্বের শিল্পবোধ
স্বাধীন চৌধুরী : মানব সভ্যতার ইতিহাস যত দীর্ঘ- সংস্কৃতির ইতিহাস ততই গভীর। সংস্কৃতি শুধুই সামাজিক আচার, অনুষ্ঠান বা শিল্প-সাহিত্য নয়; জাতির আত্মপরিচয়েরও প্রতীক। সমাজ তার সংস্কৃতির মাধ্যমে নিজস্ব ইতিহাস, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং জীবনধারার চিহ্ন স্থাপন করে। সংস্কৃতি কখনো স্থির থাকে না; সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, নতুন প্রভাব গ্রহণ করে এবং কখনো কখনো সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। এই সংঘর্ষই সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখে, নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করে এবং সামাজিক চেতনার বিকাশ ঘটায়।
সংস্কৃতির সংগ্রাম কখনোই কেবল অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নয়; বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। একটি সমাজের সাংস্কৃতিক ধারা তার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যেমন ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বাংলার সংস্কৃতি প্রতিরোধের বাহন হিসেবে কাজ করেছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং জাতীয় চেতনার উন্মেষ- এ সবই সংস্কৃতির সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ।
সংস্কৃতির সংগ্রামের এই দ্বন্দ্ব, শিল্প এবং মানব চেতনার মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতা তার মানসিক ও নৈতিক বিকাশ সাধন করেছে। যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, সংস্কৃতি কেবল অতীতের ধারক নয়; ভবিষ্যতেরও পথপ্রদর্শক।
১.
সংস্কৃতির সংগ্রামের ইতিহাস একটি প্রাচীন ধারাবাহিকতা। মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই শিল্প ও সংস্কৃতির মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটিয়েছে। প্রাচীন মিশরের শিল্পকর্ম যেমন পিরামিড, দেবমূর্তি, হায়ারোগ্লিফিক লিপি- এসব কেবল সৌন্দর্য সৃষ্টি করেনি; এগুলো ধর্ম, শক্তি ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। মিশরের রাজারা শিল্পের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও ধর্ম ও নৈতিকতার ধারণা প্রভাবিত হয়েছে।
গ্রীক সভ্যতায়, দর্শন, নাটক ও চিত্রকলার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়েছিল। থিসফিয়ান নাট্ক ও সফোক্লিসের ট্র্যাজেডি শুধু বিনোদন নয়- মানুষের নৈতিক সংকট, সামাজিক দ্বন্দ্ব ও মানবচেতনার প্রশ্ন উত্থাপন করত। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর মধ্যযুগীয় ইউরোপে ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও মানবিক চেতনার সংঘর্ষে সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ভারতের প্রেক্ষাপটে সংস্কৃত সাহিত্য ও চিত্রকলার ইতিহাসে সংগ্রামের দৃষ্টান্ত অসংখ্য। বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ কেবল ধর্মগ্রন্থ নয়; এগুলো সামাজিক ও নৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে মানুষের মানসিক বিকাশের প্রতিফলন। মধ্যযুগে কবি-সাধক ও চিত্রশিল্পী সমাজের অন্যায়, অবিচার ও সামাজিক নিয়মের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। রেনেসাঁর পর পশ্চিমা প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতিতে নতুন বৈচিত্র্য ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সংস্কৃতির সংগ্রাম ছিল তীব্র। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, লোকশিল্প এবং জাতীয় চেতনার বিকাশের জন্য লড়াই চলছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সেই সংগ্রামের একটি অন্যতম নিদর্শন। তৎকালীন সময়ে বাংলা সাহিত্যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জয়নুল আবেদিনের মতো শিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে সংগ্রামকে বেগবান করেছেন।
মৈথিলী চিত্রকলা, নকশীকাঁথা, কাঠের খোদাই-এসব শুধুই শিল্প নয়; সামাজিক ইতিহাসের দলিল। এগুলো দেখায় কিভাবে স্থানীয় মানুষ তাদের জীবনের প্রতিফলন, সংগ্রাম এবং আশা শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এভাবে সংস্কৃতির সংগ্রাম মানব সভ্যতার সঙ্গে সমানতালে চলেছে।
২.
আধুনিক যুগে সংস্কৃতির সংগ্রাম নতুন মাত্রা পেয়েছে। বৈশ্বিকীকরণের প্রভাবে একদিকে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটছে, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংস্কৃতির বিস্তার বেড়েছে। এখন এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতিকে স্পর্শ করছে, গ্রহণ করছে, কখনও কখনও প্রতিযোগিতা করছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এবং আধুনিকায়নের ফলে ঐতিহ্যকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। শহুরে জীবনে পশ্চিমা পোশাক, গান, চলচ্চিত্র এবং খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব স্থানীয় ঐতিহ্যকে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলছে। তবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় শিল্পী এবং শিক্ষিত জনগণ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
উদাহরণস্বরূপ, ঢাকাভিত্তিক নাট্যকলা আন্দোলন, চট্টগ্রামের লোকসংগীত সংরক্ষণ,ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকসংগীত,লোকগাথা,বরিশালের জামালপুরের নকশীকাঁথার পুনর্জাগরণ- এসব উদ্যোগ কেবল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করছে না, নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে এই উদ্যোগগুলো আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। সামাজিক মাধ্যমের কারণে সংস্কৃতির দ্রুত বিস্তার ঘটলেও মান ও গভীরতার অবক্ষয়ও ঘটছে। জনপ্রিয়তা অর্জনের তাগিদে অনেক সময় প্রকৃত শিল্পবোধ ও ঐতিহ্যের রেওয়াজ বিসর্জন দিতে হয়। সংক্ষিপ্ত ভিডিও এবং বাণিজ্যিক পপ গান- এসব সাংস্কৃতিক প্রকাশের আধুনিক রূপ হলেও তা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির স্থান অর্জন করতে পারে না।
৩.
শিল্প সংস্কৃতির প্রধান বাহক। সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র- এসবের মাধ্যমে সংস্কৃতির সংগ্রাম এগিয়ে যায়। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বাংলা সাহিত্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কবিতা, কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা, জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলায় জাতীয় সংগ্রামের চিত্র ফোটে উঠে। শিল্পকে মাধ্যম করে সংস্কৃতির জাগরণ তৈরি হয়েছে।
শিল্প শুধু সংগ্রামের ছবি তুলে ধরেনি; মানসিক ও নৈতিক বিবেচনার ক্ষেত্রও তৈরি করেছে। কবিতা, গান বা চিত্রকলা মানুষের সচেতনতা বাড়িয়েছে, সামাজিক অনৈতিকতা, অবিচার বা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের ‘জাতীয় সংগীত’ শুধু গান নয়; সংগ্রামের পথে এক সাংস্কৃতিক চেতনা। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কাব্য সমাজের বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রকাশিত তীব্র সাহিত্য আন্দোলন।
ডিজিটাল যুগে শিল্পের রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন থিয়েটার, ডিজিটাল চিত্রকলা- এসব আধুনিক শিল্পের নতুন রূপ।
এসব সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাচ্ছে, তবে একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করছে। এই আধুনিক শিল্পের মাধ্যমে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪.
ভবিষ্যতে সংস্কৃতির সংগ্রাম আরও জটিল ও বৈচিত্র্যময় হবে। বৈশ্বিকীকরণ, প্রযুক্তির উন্নতি এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সম্মিলনে নতুন ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে। ডিজিটাল যুগে সংস্কৃতি দ্রুত বিস্তৃত হলেও স্থানীয় এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশে সংস্কৃতির সংগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সরকারের নীতি এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বের ওপর। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি শিক্ষার মান বৃদ্ধি, নৃত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলার যথাযথ প্রচার-প্রসারের উদ্যোগ প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ এবং শিল্পীরা যদি নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন, তবে এই সংগ্রাম সফল হবে।
ভবিষ্যতের সংস্কৃতির সংগ্রাম কেবল ‘সংরক্ষণ’ নয়; নতুন দিকনির্দেশনা, সমন্বয় এবং সৃজনশীল অভিযোজনের ক্ষেত্র হবে। স্থানীয় ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে, অন্যদিকে বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে হবে। শিল্প, সাহিত্য এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে এই দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকবে, কিন্তু মানবজাতির মানসিক ও নৈতিক বিকাশের জন্য তা অপরিহার্য।
৫.
সংস্কৃতির সংগ্রাম চিরন্তন এবং তা নিরন্তর।যা একটি জাতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নয়; বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা সূচক হিসেবে কাজ করে। ইতিহাস প্রমাণ করে, সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে কোন জাতি আত্মপরিচয়, জাতীয় চেতনা, সামাজিক ন্যায় এবং নৈতিক মূল্যবোধ অর্জন করেছে। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত এবং চিত্রকলার মাধ্যমে এই সংগ্রাম অগ্রগতি লাভ করেছে।
আজকের বিশ্বে, বৈশ্বিকীকরণ, ডিজিটাল মিডিয়া এবং পশ্চিমা প্রভাবের কারণে সংস্কৃতির সংগ্রাম নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে ঐতিহ্যের সংস্কৃতি রক্ষা, শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের ইতিবাচক অগ্রগায়ন সম্ভব। আমাদের দায়িত্ব সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, সৃজনশীল বিকাশে অবদান রাখা এবং নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সঙ্গে যথাযথভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া।
সংস্কৃতি শুধু অতীতের ধারক নয়; ভবিষ্যতেরও পথপ্রদর্শক। এই সংগ্রাম চিরন্তন এবং মানব সভ্যতার মানসিক, নৈতিক ও শিল্পসমৃদ্ধ বিকাশের মূল চালিকাশক্তি।
সূত্রসমূহঃ
১. প্রাচীন মিশরের শিল্প- উইকিপিডিয়া
২. সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস।
৩. লোকশিল্প থেকে চারুকলা পর্যন্তঃ মৈথিলের ইতিহাস- রিসার্চগেট।
৪. বাংলা ভাষা আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস-স্থানীয় গবেষণা ও সরকারি নথি।
৫. ডিজিটাল মিডিয়া ও আধুনিক সংস্কৃতির প্রভাব-সংবাদ-প্রতিবেদন ভিত্তিক।